ব্যবস্থাপনার নীতি বা আদর্শসমূহ

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ২য় পত্র | | NCTB BOOK
8

ব্যবস্থাপনা নীতি হলো ব্যবস্থাপনা কার্য সম্পাদনে দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা কতিপয় সাধারণ নির্দেশিকা বা নিয়ম-পদ্ধতি । এরূপ নির্দেশিকা মেনে চললে ব্যবস্থাপনা কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পাদন করা সম্ভব হয়। তাই এরূপ নির্দেশিকা কী হতে পারে তা নির্ধারণের জন্য ব্যবস্থাপনা বিশারদগণ চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয়কে নীতি হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। এফ. ডব্লিউ. টেলর, এল. উরউইক, হেনরি ফেয়ল ইত্যাদি মনীষীবর্গের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য । আধুনিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের জনক হেনরি ফেয়ল ফরাসী ভাষায় তাঁর লেখা Administration Industrielle et General গ্রন্থে ব্যবস্থাপনার ১৪টি মূলনীতির নির্দেশ করেছেন যা অদ্যাবধি বিশ্বের সকল মহলে স্বীকৃত হয়ে আসছে। নিম্নে তার প্রদত্ত মূলনীতিসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. কর্ম বিভাজন বা কার্য বিভাগের নীতি (Principle of division of work) : প্রতিষ্ঠানের কাজকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করার নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় কার্য বিভাজনের নীতি বলে । যে কোনো ব্যবস্থাপনা কার্যে কর্ম বিভাজন বা কার্য বিভাগ এর প্রথম ও প্রধান পালনীয় নীতি । একজন ব্যবস্থাপক অধস্তন জনশক্তি নিয়ে কাজ করেন। এদের কাজ যদি ভাগ করে সেভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া না হয় তবে কার্যক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেবে। প্রত্যেকেই সহজ বা মর্যাদাসম্পন্ন কাজটি করতে চাইবে। অন্যদিকে প্রত্যেকের কাজ নির্দিষ্ট না থাকায় কাউকে জবাবদিহি করাও যাবে না। তাই একজন ব্যবস্থাপককে সবসময়ই সতর্কতার সাথে কাজকে ভাগ করে প্রত্যেক কাজের দায়িত্ব ও ক্ষমতা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে নির্দিষ্ট করে দিতে হয়। যাতে কর্মী তার কাজ, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বুঝে নিয়ে সেভাবে কাজ করতে পারে। এতে একই ধরনের কাজ করতে যেয়ে কর্মীর কার্যদক্ষতা যেমনি বাড়ে তেমনি ব্যবস্থাপকের পক্ষে অধস্তনদের কাজ তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহিতা করা সহজ হয়।

২. কর্তৃত্ব ও দায়িত্বে সমতা রক্ষণের নীতি (Principle of balancing authority and responsibility): কর্তৃত্ব হলো আদেশ দানের অধিকার। অন্যদিকে দায়িত্ব হলো জবাবদিহি করার বাধ্য-বাধকতা । এই অধিকার ও বাধ্য-বাধকতায় সমতা রক্ষার নীতিকেই কর্তৃত্ব ও দায়িত্বে সমতা রক্ষণ বলে। কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে সঠিকভাবে কাজ পেতে চাইলে তাকে যেমনি কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হয় তেমনি উভয়ের মধ্যে যাতে সমতা বজায় থাকে সেটিও নিশ্চিত করা আবশ্যক। একজনকে হিসাব নিরীক্ষার দায়িত্ব দিলে তাকে প্রয়োজনীয় খাতা-পত্র ও হিসাব তলব করার কর্তৃত্বও প্রদান করা উচিত । অন্যথায় তার পক্ষে হিসাব নিরীক্ষার কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। একইভাবে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যদি অনেক বেশি থাকে কিন্তু সেই পরিমাণে কারও নিকট তাকে জবাবদিহি করতে না হয় তবে ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী হতে বাধ্য । অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী নেতৃত্ব সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ এখানেই ।

৩. কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের নীতি (Principle of centralization and decentralization): প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যবস্থাপনার কোন পর্যায়ে গ্রহণ করা হবে এ বিষয়ক নীতিকেই কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের নীতি বলে । যদি এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল ক্ষমতা ব্যবস্থাপনার উপরিপর্যায়ে সংরক্ষণ করা হয় তাকে কেন্দ্রীকরণ বলে। অন্যদিকে এরূপ ক্ষমতা নিচের পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের হাতে ছেড়ে দেয়া হলে তাকে বিকেন্দ্রীকরণ বলে । একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য সম্পূর্ণ কেন্দ্রীকরণ ও সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ কোনোটিই লাভজনক নয়। সম্পূর্ণ কেন্দ্রীকরণ অধস্তনদের গুরুত্ব হ্রাস করে। ফলে তাদের দক্ষতা ও আগ্রহ হ্রাস পায়। অন্যদিকে সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে ঊর্ধ্বতন অধস্তনদের ওপর কর্তৃত্ব হারায় । তাই প্রতিষ্ঠানে উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠানের উপরিস্তরে এবং কম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থাপনার নিচের স্তরে প্রদান আবশ্যক ।

৪. আদেশের ঐক্য নীত (Principle of unity of command): একজন কর্মীর আদেশকর্তা হবেন একজন মাত্র ব্যক্তি-এরূপ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিতকরণের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় আদেশের ঐক্য নীতি বলে। অর্থাৎ কোনো অধস্তন (Subordinate) একজন ঊর্ধ্বতন (Boss) এর নিকট থেকেই সরাসরি আদেশ লাভ করবে এবং তার কাজের জন্য ঐ ঊর্ধ্বতনের নিকট জবাবদিহি করবে। কখনই একাধিক ব্যক্তির নিকট থেকে আদেশ লাভ বা এভাবে জবাবদিহি করবে না । ধরা যাক, প্রতিষ্ঠানে ৫ জন ফোরম্যান ক নামক একজন সুপারভাইজারের অধীন। এক্ষেত্রে উক্ত ৫ জন ফোরম্যানের প্রত্যেকের একক আদেশদাতা হলেন ক। এক্ষেত্রে উক্ত প্রত্যেক ফোরম্যান তাদের অধস্তন শ্রমিকদের কাজের জন্য ক এর নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। যদি উক্ত ফোরম্যানদের দু'জন আদেশকর্তা থাকে এবং দু'জন দু'ধরনের আদেশ দেন তবে অধস্তনদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কাজ করা কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না। একজন অফিস পিয়ন যদি একাধিক বিভাগীয় প্রধানের অধীনে কাজ করে তবে সেক্ষেত্রেও দ্বৈত অধীনতার কারণে তার কাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়াই স্বাভাবিক ।

৫. নির্দেশনার ঐক্য নীতি (Principle of unity of direction): উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পূর্ব নির্দেশনার সাথে মিল রেখে পরবর্তী নির্দেশনা প্রদানের কাজকেই ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনার ঐক্য নীতি বলে । একটা সামগ্রিক উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টি মাথায় রেখে তার আলোকে প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে । ধরা যাক, প্রতিষ্ঠানে কিছু যোগ্য বিক্রয় কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। এ জন্য বিজ্ঞপ্তি তৈরি, পত্রিকায় প্রেরণ, আবেদনপত্র জমা গ্রহণ, আবেদন পত্র বাছাই, নিয়োগ পরীক্ষার কার্ড ইস্যু, পরীক্ষা অনুষ্ঠান ইত্যাদি বিষয়ে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপককে সংশ্লিষ্ট অধস্তনদের ধারাবাহিক নির্দেশনা দিতে হবে। এক্ষেত্রে যদি তিনি একবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার নির্দেশ দিয়ে পরে আবার সেখান থেকে সরে এসে বিজ্ঞপ্তি লিখে দেয়ালে দেয়ালে টাঙানোর নির্দেশ দেন, পরীক্ষা কিভাবে নেয়া হবে এ বিষয়ে পূর্ববর্তী নির্দেশনার সাথে মিল না রেখেই পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করেন তবে স্বভাবতই উদ্দেশ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে এবং এতে ঊর্ধ্বতন সম্পর্কে অধস্তনদের মনে খারাপ ধারণা জন্মাবে।

৬. সাধারণ স্বার্থে নিজস্ব স্বার্থ ত্যাগের নীতি (Principle of subordination of individual interest to general interest): ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রাতিষ্ঠানিক বা সাধারণ স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদানের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় সাধারণ স্বার্থে নিজস্ব স্বার্থ ত্যাগ এর নীতি বলে। একটা ব্যবসায়ে কর্মরত প্রতিটা ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগ যদি প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে বড় করে দেখে তবে সেক্ষেত্রে দলীয় চেতনা (Team spirit) বৃদ্ধি পায় ও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তারা ছোটখাটো বিভেদ এড়িয়ে চলে। এতে প্রতিষ্ঠান অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারে । এতে জনশক্তির বেতন ও সুযোগ-সুবিধাও বাড়ে। অন্যদিকে যদি কর্মরত প্রত্যেকেই নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখে তবে প্রাতিষ্ঠানিক বা সাধারণ স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় । একটা দেশের ক্ষেত্রেও এ নীতি প্রযোজ্য । সরকার, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবাই যদি দেশপ্রেম নিয়ে দেশের স্বার্থকে বড় মনে করে কাজ করে তবে দেশ ও দেশের মানুষ সবাই উপকৃত হয় । কিন্তু যখন প্রত্যেকেই যার যার জায়গায় ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করাকে অগ্রাধিকার দেয় তখন এক পর্যায়ে দেশ ও জনগণ সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
৭. জোড়া-মই-শিকলের নীতি (Principle of scalar chain) : প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে শুরু করে একেবারে নিচের স্তর পর্যন্ত সাংগঠনিক নিয়মে প্রতিটা ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগকে একে অন্যের সাথে যুক্ত করে দেয়ার বা একই শিকলের অধীনে সবাইকে আবদ্ধ করার নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় জোড়া মই-শিকল নীতি বলে । এতে শিকলের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পারস্পরিক আবদ্ধতা কর্তৃত্ত্বের প্রবাহ ও যোগাযোগের পথ নির্দেশ করে। কে কার অধীন, কে কার অধস্তন সহজে বোঝা যায়। ফলে সংঘবদ্ধতা জোরদার হয় । প্রতিষ্ঠানের যে কোনো পর্যায়ে সমস্যা দেখা দিলে তা উর্ধ্বতন সহজে জানতে পারে ও দ্রুত তার সমাধা সম্ভব হয়ে থাকে। উল্লেখ্য কোনো ব্যক্তি দলছাড়া হয়ে গেলে বা দলের বাইরে থাকলে তা তার জন্য যেমনি সমূহ ক্ষতি বয়ে আনতে পারে তেমনি দলের জন্যও তা ক্ষতির কারণ হয়। একটা প্রতিষ্ঠানে কোনো ব্যক্তি, বিভাগ বা উপবিভাগ যদি এই শিকলের বাইরে থাকে তবে তাকে বা তাদের কাজে লাগানো বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ঐ ব্যক্তি বা বিভাগ স্বেচ্ছাচারী হয় এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য তা মন্দ উদাহরণ সৃষ্টি করে ।

৮. নিয়মানুবর্তিতার নীতি (Principle of discipline): প্রতিষ্ঠানের জন্য উত্তম নিয়ম-নীতি নির্ধারণ এবং তা মেনে চলার নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় নিয়মানুবর্তিতার নীতি বলে । প্রতিষ্ঠানে যথোপযুক্ত নিয়ম-নীতি না থাকলে এবং তা সংশ্লিষ্ট সবাই মান্য না করলে প্রতিষ্ঠান কখনই ভালো চলতে পারে না । এই নীতি অনুযায়ী মনে করা হয়। যে, প্রাতিষ্ঠানিক নীতি ও নিয়মের প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ ও তা মান্য করার ঐকান্তিক আগ্রহ সফলতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে লক্ষণীয় যে, সেখানে নিয়ম-নীতি থাকলেও অনেকেই তা পরোয়া করে না । ফলে সেখানকার কার্যপরিবেশ ও সংশ্লিষ্টদের কার্যদক্ষতার মান খুবই হতাশাব্যঞ্জক । অন্যদিকে বেসরকারি বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহে সুষ্ঠু নিয়ম-নীতি প্রণয়ন ও তা মান্য করার বিষয়ে খুবই জোর দেয়া হয়। ফলে সেখানে কার্য পরিবেশ ও কার্যমান উন্নত হয়ে থাকে । হেনরি ফেওল এক্ষেত্রে মনে করেছেন যে, ঊর্ধ্বতনগণ যদি নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন তবে প্রতিষ্ঠানে নিয়মানুবর্তিতার নীতি অনুসরণ সহজ হয়।

৯. শৃঙ্খলার নীতি (Principle of order): যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে এবং সঠিক বস্তুকে সঠিক স্থানে স্থাপনের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার নীতি বলে। এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বলতে উপায়-উপকরণাদির শৃঙ্খলাকে বুঝানো হয় । যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে বসানো না গেলে কখনই তার নিকট থেকে কাঙ্ক্ষিত ফললাভ সম্ভব হয় না । আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠানে প্রায়শই লক্ষণীয় যে, ব্যক্তির যোগ্যতা বা মেধার চাইতেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক, রেফারেন্স, ব্যক্তিগত লাভালাভ ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে মানবীয় শৃঙ্খলা বলতে সেখানে কিছুই থাকে না । কার্যত অদক্ষতা-অযোগ্যতাকেই সেখানে লালন করা হয়। যা কখনই প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো ফল দেয় না। অন্যদিকে যেই প্রতিষ্ঠান যোগ্য লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে আন্তরিক থাকে সেখানে কখনই অদক্ষতা, অনিয়ম ইত্যাদি ভর করতে পারে না । বস্তুগত শৃঙ্খলার বিষয়টাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । যে যন্ত্রটি যেখানে থাকা দরকার, যাকে যে ধরনের টেবিল-চেয়ার দেয়া দরকার, কারখানা বিন্যাস, অফিস বিন্যাস ইত্যাদি যেভাবে হওয়া প্রয়োজন তা সেভাবে করলেই তদ্বারা উপযুক্ত ফললাভ সম্ভব।

১০. পারিশ্রমিকের নীতি (Principle of remuneration): প্রতিষ্ঠানের প্রতিটা কর্মীর কাজের প্রকৃতি, মেধা, যোগ্যতা ইত্যাদি বিবেচনায় উপযুক্ত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় পারিশ্রমিকের নীতি বলে । যে কোনো প্রতিষ্ঠানেই কর্মরত জনশক্তি তার মেধা, যোগ্যতা ও কাজ অনুযায়ী উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রত্যাশা করে । মালিক পক্ষও তাদের বিনিয়োগকৃত মূলধনের বিপক্ষে উপযুক্ত মুনাফা পেতে চায়। তাই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদেরকে উভয় পক্ষের প্রত্যাশা পূরণে যত্নশীল হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায় জগতে প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য ও দক্ষ জনবল ধরে রেখে দক্ষতার সাথে কার্যক্রম পরিচালনায় এ নীতির যথাযথ অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই ।

১১. সাম্যের নীতি (Principle of equity): অধস্তনদের সবার প্রতি সমান আচরণ বা স্নেহ প্রদর্শনের নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় সাম্যের নীতি বলে । এটি ন্যায়পরায়ণতার সাথেও সম্পর্কযুক্ত। একজন ঊর্ধ্বতন যদি তার সকল অধস্তনকে সমান চোখে দেখেন, সমান আচরণ ও স্নেহ প্রদর্শন করেন তবে অধস্তনদের মাঝে ঊর্ধ্বতন সম্পর্কে সুধারণা গড়ে ওঠে। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় । প্রতিষ্ঠানে আনুগত্য, মান্যতা ও কার্যদক্ষতা বৃদ্ধি পায় । অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন যদি তার অধস্তনদের সমান চোখে না দেখেন, বেতন, পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি প্রদানে বৈষম্য করেন তবে সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র ঊর্ধ্বতনের প্রতিই খারাপ ধারণার সৃষ্টি হয় না কর্মীদের নিজেদের মধ্যেও বিবাদ-বিসম্বাদ দেখা দেয়। একজন কর্মী অন্যায় করলেও ঊর্ধ্বতন যদি তার অন্যায় বিবেচনায় শাস্তি প্রদানে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেন এবং অধস্তন হিসেবে তার সাথে আর পাঁচজনের মতই ব্যবহার করেন তবে উক্ত অধস্তনের মনে ঊর্ধ্বতনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে না বরং বৃদ্ধি পায়।

১২. চাকরির স্থায়িত্বের নীতি (Principle of stabilization of service) : এই নীতি অনুযায়ী মনে করা হয়। যে, কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা বিধান করা হলে তা কর্মীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে । সাধারণভাবে একজন যুবক লেখাপড়া শেষে ভালো চাকরি পাওয়াটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যখন সে চাকরি পায় তখন চাকরিটা স্থায়ী হোক এটাই তার প্রত্যাশার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ পর্যায়ে চাকরি স্থায়ী করা হলে সে তা নিজের জন্য গৌরবের বিষয় মনে করে। এ সময় থেকেই সে নিজেকে প্রতিষ্ঠানের একজন প্রকৃত সদস্য গণ্য করে যা তার কাজের গতি বাড়িয়ে দেয় । কিন্তু প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের চাকরি যদি স্থায়ী করা না হয় তবে ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মনে যে কোনো সময় চাকরি চলে যাওয়ার ভয়, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাসা বাঁধে। সে অন্যত্র চাকরি খুঁজতে বাধ্য হয় । একসময় সে কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে । তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যোগ্য কর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণের ব্যবস্থা নেয়া উচিত ।

১৩. উদ্যোগের নীতি (Principle of initiative) : প্রতিষ্ঠানের সকল পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগণ স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে যাতে উদ্যোগী হতে পারে বা নিজের কাজের উন্নয়ন বিষয়ে ভাবতে পারে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তার সুযোগ, সৃষ্টিকেই ব্যবস্থাপনায় উদ্যোগের নীতি বলে। ঊর্ধ্বতনদের পক্ষে প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কাজের মান উন্নয়ন বা বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠার বিষয়ে কার্যকর চিন্তা করা সম্ভব হয় না । তাই প্রতিষ্ঠানে যদি এমন পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয় যাতে প্রত্যেক অধস্তন স্ব স্ব স্থানে তাদের কাজের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে ও ঊর্ধ্বতনদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারে তবে স্বভাবতই অধস্তনরা উদ্যোমী ও উদ্যোগী হয়ে ওঠে । যা অধস্তনদের প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজকে সম্পৃক্ত করতে উৎসাহ যোগায়। অন্যদিকে যদি এ ধরনের পরিবেশকে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং এ ধরনের চিন্তাকে অধস্তনদের বাড়াবাড়ি বলে গণ্য করা হয় তবে নিঃসন্দেহে তা স্বচ্ছন্দ ও স্বতঃস্ফূর্ত কর্ম পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করে।

১৪. একতাই বল নীতি (Principle of unity is strength) : প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগকে সর্বাবস্থায় ঐক্যবদ্ধ থেকে পারস্পরিক সহযোগিতায় কর্মকাণ্ড পরিচালনার নীতিকেই ব্যবস্থাপনায় একতাই বল নীতি বলে । প্রতিটা বিভাগ ও উপবিভাগের অধীন ব্যক্তিবর্গ যদি বিভাগীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং প্রতিটা বিভাগ ও উপবিভাগ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রত্যেকের কাজকে অন্যের সাথে সমন্বিত করে একতালে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তবে প্রতিষ্ঠান সহজেই তার মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পারে । কিন্তু সর্বত্র ঐক্য, সমঝোতা ও সহযোগিতা যদি না থাকে তবে পারস্পরিক বিরোধ, অনৈক্য ও অসহযোগিতা সেখানে প্রকট হয়ে দেখা দেয়। যেখানে প্রতিষ্ঠান কখনই সাফল্য লাভ করতে পারে না। তাই ঊর্ধ্বতনদেরকে এরূপ নীতি বাস্তবায়নে সদা তৎপর থাকতে হয় ।

H. Fayol বর্ণিত উপরোক্ত মূলনীতিসমূহ ছাড়াও বর্তমানে আরও কিছু নীতি ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনায় সাধারণ দিক-নির্দেশনা প্রদান করতে পারে বলে মনে করা হয় :

১. নমনীয়তার নীতি (Principle of flexibility) : চিন্তা, কাজ ও পদ্ধতিতে প্রয়োজনে পরিবর্তন এনে প্রচেষ্টাকে লক্ষ্যাভিমুখী করার নীতিকেই নমনীয়তার নীতি বলে। ব্যবস্থাপনা সমাজ বিজ্ঞানের একটি শাখা। তাই সামাজিক বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিবেশের মধ্য দিয়ে ব্যবস্থাপনাকে তার উদ্দেশ্য অর্জন করতে হয়। তাই এরূপ নীতির মূল বক্তব্য হলো পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে সঙ্গতি বিধানে ব্যবস্থাপনার সমর্থ থাকা উচিত । এজন্য ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত যে পরিবর্তন ঘটে তার সঙ্গে ব্যবস্থাপনাকে সঙ্গতি বিধান করে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে ।

২. ভারসাম্যের নীতি (Principle of balancing) : ভারসাম্যের নীতি বলতে প্রতিটা ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগীয় কাজের মধ্যে সমন্বয় বিধান এবং সমতালে এগিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য সৃষ্টিকে বুঝায়। কোনো বিভাগের কাজের দায়িত্ব এবং গুরুত্ব বুঝে লোকবল ও সামর্থ্য নিয়োজিত করা উচিত; যাতে কোন বিভাগ অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে না পড়ে । সকল বিভাগ, উপবিভাগ ও ব্যক্তির কাজ ভারসাম্যপূর্ণ হলে তা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক কাজে ভারসাম্যাবস্থার সৃষ্টি করে ।

৩. ব্যতিক্রমের নীতি (Principle of exceptions) : ব্যবস্থাপক কোন ক্ষেত্রে তার দৃষ্টি অধিক নিবদ্ধ করবে এরূপ নীতিতে তার প্রতি আলোকপাত করা হয়ে থাকে। একজন ব্যবস্থাপকের পক্ষে তার সবগুলো কাজ সমান গুরুত্ব দিয়ে করা সম্ভব হয় না। এজন্য কোন্ কাজটি উদ্দেশ্য অর্জনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, কোন্ ক্ষেত্রে অধিক বিচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনা বিদ্যমান ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে সেভাবে দৃষ্টি প্রদান এবং ব্যবস্থাপনা কার্য পরিচালনা করা আবশ্যক।

Content added By

# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন

Promotion